টগর ফুল Pinwheel Flower, কাঠমল্লিকা, কাঠকরবী, কাঠমালতী, চাদনী, অনন্ত সাগর, Crape jasmine, Carnation of India, pin-wheel flower ইত্যাদি নামের Apocynaceae পরিবারভুক্ত এই ফুলের গাছটি চিরসবুজ ঝোপঝাড়বিশিষ্ট গাছ। ঝাঁকড়া মাথার জন্য টগর গাছ সুন্দর। ডালগুলোও সোজা ওঠে না, বহু শাখা-প্রশাখা নিয়ে ঝোঁপের মতো বাগানের শোভা বাড়ায়। সুন্দর করে ছেঁটে দিলে চমৎকার ঘন ঝোঁপ হয়।। ক্রান্তীয় আমেরিকার প্রজাতি। বড় আকারের গুল্ম, কখনো বৃক্ষসম।
উজ্জ্বল সবুজ, নিচ ফ্যাকাশে, মসৃণ। শীত ছাড়া প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। গন্ধহীন বা সুগন্ধি দুই ধরণেরই ফুল পাওয়া যায়। পাতার কক্ষে বা ডালের আগায় সাদা ফুলে গাছ ভরে যায়। বনে জঙ্গলেও এই গাছ পাওয়া যায়। একটি প্রজাতির ফুল ৩-৫ সেমি চওড়া, সিঙ্গল বা আধা ডাবল, ডাবল, গন্ধহীন, দলনলের আগায় ৫ টি পাপড়ি, চ্যপ্টা, কোনো ফুলের পাপড়ির আগা চোখা কোনোটি গোলাকার। অপর প্রজাতি, ফুল বড়, ডাবল, সুগন্ধি।
আবার নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ুয়া তার গাছপালা তরুলতা বইয়ে লিখেছেন,
টগর দুই রকম- থোকা টগর ও একক টগর। বাংলাদেশ ও ভারতে এই দুই রকমের টগর পাওয়া যায়। একটি টগরের একক পাপড়ি, অন্যটির গুচ্ছ পাপড়ি। এদের “বড় টগর” ও “ছোট টগর” বলা হয়।
সারা পৃথিবীতে এই গণের ৪০ টি প্রজাতি আছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এই গাছ আমাদের দেশে এসেছে। এর মধ্যে বাংলা ও ভারতে ৪টি প্রজাতি পাওয়া যায়। কলম করে চারা করা যায়, আবার বর্ষাকালে ডাল লাগালেও হয়। টগর সমতল ভূমির গাছ। পর্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা যায়। বাংলাদেশের বনে-বাদাড়ে টগর এমনিতেই জন্মে। টগরের কাণ্ডের ছাল ধূসর। গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে সাদা দুধের মতো কষ ঝরে বলে একে “ক্ষীরী বৃক্ষ” বলা যায়। পাতা ৪-৫ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা ও এক দেড় ইঞ্চি চওড়া হয়। পাতার আগা ক্রমশ সরু। ফুল দুধ-সাদা। থোকা টগরের সুন্দর মৃদু গন্ধ হয় কিন্তু একক টগরের গন্ধ নেই। ফুল থেকে ফলও হয়। তার মধ্যে ৩ থেকে ৬ টি বীজ হয়। বড় টগরের বোঁটা মোটা এবং একক ফুল হয়। পাতাও একটু বড়।
চোখের দেখায় টগরকে মোটা দাগে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়।
একক টগর।
একক টগর ফুলে পাপড়ি সংখ্যা থাকে পাঁচটি। সাধারণত একক টগরের কোনো সুগন্ধ থাকে না।
একক টগরের আরেকটি রূপ হচ্ছে জংলি টগর। জংলি টগরের এক একটি ডালে প্রতিদিন প্রায় ১২ থেকে ১৫ টি ফুল ফুটে।
একক টগরের অন্য আরেকটি প্রজাতি এখন খুব চোখে পরে শহরের শৌখিন বাগানে, বাড়ির সামনের লনে, টবে। সেটিকে চাইনিজ টগর বলা হচ্ছে। জংলি টগরের মিনি সংকরণ বলা চলে একে।
থোকা টগর।
থোকা টগরকে বড় টগরও বলা হয়। এই টগরের পাপড়ির সংখ্যা দুই স্তর মিলিয়ে অনেকগুলি থাকে। থোকা টগরের আছে মিষ্টি সুগন্ধি। এই সুগন্ধি মৌমাছি, প্রজাপতি ইত্যাদি পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে সহজেই। গাছের পাতা একটু বড়। এরা বড় আকারের গুল্ম, কখনও বৃক্ষসম হয়ে উঠে। বড় টগর গাছে ছোট পাখিরা সন্ধ্যার পরে আশ্রয় নেয়।
টগরের কাণ্ড বা ডাল ভাঙ্গলে দুধের মতো সাদা কষ বের হয় বলে অথবা দুধ সাদা ফুলের রং এর কারণে কোনো কোনো এলাকায় এটিকে “দুধফুল” বলে ডাকে। টগর গাছের পাতা বা ডাল ছিঁড়লে যেহেতু সাদা দুধের মতো কষ বের হয় সেহেতু একে “ক্ষীরী বৃক্ষ” বলা যায়।
টগরের চারা করা হয় সাধারণত কলম করে। তাছাড়া বর্ষাকালে ডাল কেটে মাটিতে পুতে রাখলেও চারা হয়ে যায়। টগর সমতলের গাছ হলেও পাহাড়েও এদের বেশ দেখতে পাওয়া যায়। এরা সমতল ও পাহাড় দুই যায়গাতেই বেশ মানান সই।
কোনো যত্ন ছাড়াই ঝোপঝাড়ে, পথের ধারে, জঙ্গলে, বাঁশ ঝারে টগর ফুল এমনিতেই জন্মে থাকে। সে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য হতো যখন গ্রামের নির্জন পথের দুপাশে জঙ্গল ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে জংলি টগর তার ডালি সাজিয়ে বসতো। জংলি টগর সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে নিজের সৌন্দর্যের শুভ্রতা ছড়াতো সাদা সাদা ফুলে। মূলতো যে প্রজাতির টগর বনে জঙ্গলে জন্মাতে দেখা যায় তাকেই “জংলি টগর” বলে।
শীতকালে কম হলেও বছরই টগর গাছে ফোটে ফুল, তবে বসন্তে ফুলের পরিমান বেড়ে যায় অনেক বেশী। ফুল গন্ধহীন ও সুগন্ধীযুক্ত উভয়ই হতে পারে।
এছাড়া, মাটির পিএইচ ৬ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে হওয়া ভালো, অর্থাৎ সুষম পুষ্টির মাটি এটি পছন্দ করে। এটি খুব বেশি ঠান্ডা বা শীতল পরিবেশে ভালোভাবে বেড়ে ওঠে না।
টগরের মূল ও শেকড় ওষুধে ব্যবহৃত হয়। শেকড় তেতো ও কটু স্বাদের। এতে কৃমি ও চুলকানি দূর হয়। ঘামাচিতে টগরের কাঠ ঘষে প্রতিদিন চন্দনের মতো গায়ে মাখলে উপকার হয়। অনেকে টগরের কাঁচা ডাল চিবিয়ে দাঁতের অসুখ সারায়।
টগর গাছটি তার সুন্দর ও উজ্জ্বল ফুলের জন্য এক অতিরিক্ত সৌন্দর্য যোগ করে। এটি সঠিক যত্ন এবং সঠিক পরিবেশে সহজেই বেড়ে ওঠে। মৌসুম অনুযায়ী সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করলে, এই গাছটি আপনার বাগানে একটি অপরিসীম সৌন্দর্য নিয়ে আসবে। গ্রীষ্মকাল ও বসন্তে ফুল ফুটানোর সময় গাছটির জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হবে, এবং শীতকালে এটি সুরক্ষিত রাখতে হবে।