বিস্ময়কর এবং আশ্চযর্জনক সুমিষ্ট স্বাদের রসালো এক ফলের নাম ত্বীন। এটি ডুমুর জাতীয় এক প্রকার ফল। হিন্দি, মারাঠি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় এই ফলকে আঞ্জির বলা হয় এবং আরবি ভাষায় এর নাম ত্বীন।
ত্বীন ফল বাংলাদেশে ডুমুর হিসেবেই বেশি পরিচিত। ত্বীন ডুমুর জাতীয় এক ধরনের ফল। এর গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ficus carica । এটি Moraceae পরিবারের Ficus গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই ফলের আকার কাকডুমুর বা জগডুমুর এর চাইতে বড় জনপ্রিয় মিষ্টি ও রসালো ফল।
ত্বীন একটি পুষ্টি সমৃদ্ধ সুস্বাদু ফল, যা মরু অঞ্চলে ভালো জন্মে। পৃথিবীর অনেক দেশে এর চাষ হয়, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম এশিয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয় এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আফগানিস্তান থেকে পর্তুগাল পর্যন্ত এই ফলের বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে। এর আদি নিবাস মধ্যপ্রাচ্য।
চরম জলবায়ু অর্থাৎ শুষ্ক ও শীতপ্রধান দেশে চাষ হলেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতেও ৩৬৫ দিন এ ফল উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়েছে ত্বীন। শুধু তাই নয় ব্যাপকভাবে চাষ হওয়ায় আমাদের সারাবছরের পুষ্টি ও ফলের চাহিদা পূরণ করে ত্বীন বা ডুমুর রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
মুসলিম ধর্মগ্রন্থ কুরআনে ‘ত্বীন’ নামে একটি সূরা রয়েছে। সেখানে এই ফলকে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত বা অনুগ্রহরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। বাইবেলে এই ফলের উল্লেখ আছে
পবিত্র কোরআনে ত্বীন নামে একটি সুরা আছে। আত-ত্বীন সূরায় বর্ণিত ত্বীন ও জয়তুন ফলের গুণাগুণ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ্ ত্বীন ফলের নামে কসম খেয়েছেন। হযরত আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) জান্নাতে থাকাকালীন আল্লাহর নিষেধ অমান্য করে গন্ধম খাওয়ার পর যখন বস্ত্রহীন হয়ে পরেছিলেন তখন এই ত্বীন ফলের পাতা দিয়েই ওনারা লজ্জা নিবারন করেছিলেন।
তাই বলা যায়, ত্বীন একটি জান্নাতী ফল। রাসুল (সা.) ত্বীন ফল অনুসারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার সময় বলতেন, ‘এটি খাও, কারণ এতে অনেক রোগের ঔষধ রয়েছে।’
ত্বীন ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ছাড়াও প্রায় সব রকমের জরুরি নিউট্রিশনস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি আছে।
ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাবজনিত রোগে এটি বেশ কার্যকরী। কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফ্যাট, প্রোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ছাড়াও বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর ত্বীন ফল। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি ত্বীন ফলের অনেক ঔষধি গুণও রয়েছে।
পুষ্টি গুণাবলী ও ঔষধি গুণ
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
মরণব্যাধি ক্যানসার দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সচেতন রোগীর প্রাথমিক অবস্থায় রোগ ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসায় ক্যানসার পুরোপুরি সেরে যেতে পারে অথবা নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক সহজ হয়।
এর জন্য প্রতিদিন দুই থেকে তিনটি ত্বীন ফল খেতে পারেন। কারণ, এটি ক্যানসার প্রতিরোধ করে। গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব নারী ডায়েটে ত্বীন ফল রাখেন, তাদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমে। ত্বীন ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ফাইবার, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কোলন ক্যানসার রোধেও ত্বীন ফল বেশ কার্যকর।
কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে
রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি মানে হৃদপিণ্ডের ঝুঁকি। তাই এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। ত্বীন ফলের ফাইবার শরীরে দ্রুত শোষিত হয়। এর ফাইবার দ্রুত দ্রবীভূত হয়ে করতে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া ত্বীন ফলে বিদ্যমান পেকটিন কোলেস্টেরল কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ক্যালসিয়াম,পটাসিয়াম,আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ ত্বীন-কে যৌন পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম,যা সেক্স হরমোন ও এস্ট্রোজেন ও এন্ড্রোজেন উৎপাদনে সাহায্য করে। ত্বীন ফল নারী ও পুরুষের বিভিন্ন ধরনের যৌন সমস্যা সমাধান করে এবং যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে
উচ্চরক্তচাপ জনিত সমস্যায় যদি ভুগে থাকেন তবে নিয়মিত ত্বীন ফল গ্রহণ আপনার রক্তচাপ আশানুরূপভাবে কমতে শুরু করবে। ত্বীন ফলে প্রচুর পরিমাণ পটাসিয়াম বিদ্যমান। এটি উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
হজমে সাহায্য করে
ত্বীন ফলে বিদ্যমান উচ্চ ফাইবার আপনার হজমকে উন্নত করবে। এটি বিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে রেহাই দেয়। ত্বীন ফল ডায়ারিয়া নিরাময়েও কাজ করে এবং সম্পূর্ণ হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। হজমকে উন্নত করতে নিয়মিত ২-৩টি ত্বীন ফল পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে পান করুন। চাইলে সঙ্গে মধুও মিশিয়ে নিতে পারেন।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
ত্বীন ফলে আয়রনের প্রাচুর্য্য আপনার শরীরের রক্তস্বল্পতা ও আয়রনের ঘাটতি পূরণ করবে। নারীদের দেহে আয়রনের পরিমাণ ঠিক রাখা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায়ও মায়ের দেহে আয়রনের পরিমাণ নিশ্চিত করতে পারে ত্বীন ফল। এতে উপস্থিত আয়রনের কার্যকারিতা রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধ ও দূর করতে সাহায্য করে।
হাড় করে মজবুত ও শক্তিশালী
হাড়ের সুস্থতায় ক্যালসিয়াম অপরিহার্য। ত্বীনে ফলে থাকা ক্যালসিয়াম আপনার দেহে ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরন করে হাড়কে করে তুলবে মজবুত ও শক্তিশালী। এছাড়া এটি পটাসিয়ামের ভাল উৎস হওয়ায় হাড়ের ক্ষয় রোধেও উপকারী।
ওজন কমাতে সাহায্য করে
বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, এই অসাধারণ ফলটি ওজন কমাতে যেমন সাহায্য করবে তেমনি চর্মসার ব্যক্তির জন্যও বয়ে আনবে সুসংবাদ। ত্বীন ফলের উচ্চ ফাইবার দেহের অতিরিক্ত ক্যালোরি হ্রাস করতে সক্ষম। আবার এই ফল বেশি পরিমানে খেলে এর উন্নত পুষ্টি উপাদান ওজন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাই স্থুল ও রোগা উভয়ের জন্যই এটি আশীর্বাদ স্বরূপ।
অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট গুণসম্পন্ন
ত্বীন ফলের রয়েছে অসাধারণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্ষমতা। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্রিয়া আপনার শরীরকে জীবাণুমুক্ত রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। এছাড়া প্লাজমার লিপোপ্রোটিন বৃদ্ধিতেও এর বেশ সুনাম রয়েছে।
দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়
ত্বীন ফলটি নিয়মিত গ্রহণের মাধ্যমে আপনার দৃষ্টি ক্ষমতাকে উন্নত করতে পারেন। ম্যাকুলার অবক্ষয়ের কারনে বয়স্কদের দর্শন শক্তি লোপ পায়। এতে উপস্থিত ভিটামিন এ ম্যাকুলার অবক্ষয় রোধ করে এবং দৃষ্টি ক্ষমতাকে উন্নত করে। এছাড়াও রেটিনাল ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সক্ষম এই ফল।
ত্বকের সৌন্দর্যে
বাড়তি বয়সের ছাপ হিসেবে মুখে ফুটে উঠে বলিরেখার মত সমস্যা। এক গবেষণায় জানা যায়, ত্বীন ত্বকের বলিরেখা দূর করতে বেশ কার্যকর। এটি ত্বকে গভীর থেকে কাজ করে। ফলে ব্রণ ও ব্রনের দাগ দূর করতেও এর জুরি নেই। ভিটামিন সি এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্রিয়া ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে ত্বককে সুন্দর ও কোমল করে তোলে।
চুলের পরিচর্যায়
কেবল সুস্বাস্থ্যেই নয়, চুলের যত্নেও ত্বীন এর বিকল্প নেই। চুলপড়া কমাতে ও নতুন চুল গজাতে সাহায্য করবে এটি। কারণ, এতে আছে চুলের জন্য উপকারী ভিটামিন সি,ই ও ম্যাগনেসিয়াম। চুলের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে এর খ্যাতি বেশ পুরোনো। এটি স্ক্যাল্পের ময়েশ্চার ধরে রাখে।
গলা ব্যাথা দূর করে
গলা ব্যাথা কমাতে সহায়তা করবে ত্বীন ফল। এটি গলা ব্যাথা কেবল উপশমই করে না, তা প্রতিরোধেও কাজ করে। এটি ভোকাল কর্ডের জন্যও বেশ উপযোগী। টনসিলের নিরাময়েও ব্যবহার করা হয় ত্বীন ফল।
চাষাবাদ পদ্ধতি
ত্বীন ফলের গাছ কোনো রাসায়নিক সার ছাড়াই, মাটিতে জৈব ও কম্পোজড সার মিশিয়ে রোদে মাঠে ও ছাদে টবে লাগিয়ে ফল উৎপাদনে সাফল্য পাওয়া গেছে। তাই ছাদ বাগানীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য ফল গাছের তুলনায় এ গাছে খুব দ্রুত ফল ধরে। একটি ত্বীনের কাটিং চারা লাগানোর ৪/৫ মাস পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। তাই গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পর থেকেই টবের গাছকে নিয়মিত অল্প অল্প করে সরিষার খৈল পচা পানি দিতে হবে। এক বছর পর টবের আংশিক মাটি পরিবর্তন করে দিতে হবে। ২ ইঞ্চি প্রস্থে এবং ৬ ইঞ্চি গভীরে শিকড়সহ মাটি ফেলে দিয়ে নতুন সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে তা ভরে দিতে হবে। টবের মাটি পরিবর্তনের কাজটি সাধারণত শীতের আগে ও বর্ষার শেষে করাই ভালো। টব বা ড্রামের মাটি ১০-১৫ দিন পর পর কিছুটা খুঁচিয়ে দিতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
পোকামাকড়ের মধ্যে Meloidogyne গোত্রের নেমাটড (Nematodes) এর মাধ্যমে ডুমুর গাছের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। Arthropod এও গাছের ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টির পরিমান বেশি হলে ফল ভেঙ্গে যাওয়া রোগ (fruit splitting) হতে দেখা যায়। Alternaria, Aspergillus, Botrytis, এবং Penicillium fungi ফাংগাল রোগ দমনে ফাংগিসাইড প্রয়োগ করতে হয়। ডুমুরের আর একটি কমন রোগ হলো fig mosaic disease (FMD) যা হলে ডুমুর গাছ মোজাইকের মতো হলুদ রং ধারণ করে। এসমস্ত রোগ বা পোকার আক্রমণ হলে নিকটবর্তী কৃষি অফিসে যোগাযোগ করে পরিমিত ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ত্বীন ফল রপ্তানি করে আন্তর্জাতিক বাজার ধরা সম্ভব। সম্ভাবনাময় এই ফল চাষ করে দেশের বেকরত্ব দূরের পাশাপাশি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। বাংলাদেশে চাষাবাদ করা ত্বীন বা ডুমুরের জাতগুলোর মধ্যে নীল, মেরুন, লাল, হলুদসহ বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। এখানকার গাছে প্রতিটি ত্বীন ফল ওজনে ৭০ থেকে ১১০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে।
দেশের প্রচার মাধ্যমে ত্বীন ফলের চাষ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও বিদেশ থেকে ত্বীনের আমদানি নির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ঘরোয়া বাজারেও এই ত্বীন ফলের একটি বড় ব্যবসায়ীক সম্ভাবনা রয়েছে। এক্সোটিক বা গৌণ ফল হিসেবে স্ট্রবেরী, ড্রাগন ফ্রুটস কিংবা এভোকেডোর চেয়ে ত্বীন ফলের চাহিদা বেশি বই কম নয়।