হাইড্রেনজিয়া একটি আশ্চর্যজনক ফুল যার প্রায় ৯০ টিও বেশি প্রজাতি রয়েছে। এই ফুলের কোন গন্ধ নেই, কিন্তু এর চমৎকার একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি রঙ বদলায়। মাটির অম্লতা ও ক্ষারত্বের ভিত্তিতে রঙ নির্ধারণ করে। বসন্তের আগমন শুরু হওয়ার সাথে সাথে গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে এবং গরমের মাঝামাঝি সময় থেকে ফুল ঝড়ে যেতে থাকে।
হাইড্রেনজিয়া গাছের আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চীন,জাপান,কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। হাইড্রেনজিয়া(বৈজ্ঞানিক নাম-Hydrangea macrophylla, ইংরেজি -big leaf hydrangea, french hydrangea, lacecap hydrangea, mophead hydrangea, penny mac এবং hortensia) হচ্ছে Hydrangeaceae পরিবারের Hydrangea (হাইড্রেঞ্জা) গণের একটি গুল্ম জাতীয় ফুল গাছ।
প্রচুর ফুল পেতে হাইড্রেনজিয়া গাছের পরিচর্যা :-
প্রথমেই বলেছি হাইড্রেনজিয়া পিএইচ স্তর অনুযায়ী ফুলের রঙ পরিবর্তন হয়। উদাহরণস্বরূপ, এমন মাটির পিএইচ এর মাত্রা ৪.৫ এবং ৫.৫ এর মধ্যে থাকে বা অ্যাসিড স্তরে থাকে সেই সব গাছের ফুল ভাল হয়, ফুলগুলি একবার বিকাশ হলে তারা নীল হয়। হাইড্রেঞ্জা গাছ দুই থেকে তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হয়। টবে ও মাটিতে দু ভাবেই গাছ সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠে। ছায়াযুক্ত ও স্যাতসেঁতে জায়গায় গাছ মাটি বেশি ক্ষারীয় হলে ফুলগুলি সাদা হয়।
হাইড্রেনজিয়া ফুলের মঞ্জরি গুচ্ছবদ্ধ, বেশ বড়, আয়তাকার। পাপড়ির সংখ্যা চার বা ততোধিক, মসৃণ,পুরু, দীর্ঘস্হায়ী। হাইড্রেনজিয়া মূলত সাদা রঙের হয়। এছাড়াও গোলাপী,নীল,হালকা সবুজ, বেগুনি, লাল, ঘিয়ে এবং মিশ্র রঙের হয়ে থাকে। বড় খোঁপার মতো থোকা ধরে ফুটে থাকা সাদা, ঘিয়া বা হালকা গোলাপী কোনটাই দেখতে কম সুন্দর নয়।
টবে ও মাটিতে দু ভাবেই এই ফুলের চাষ করা যায়। ছায়াযুক্ত ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় ও গাছটি বেঁচে থাকে। আমাদের দেশে সাদা-গোলাপী মেশানো হাইড্রেনজিয়া হর্টেনসিস ভ্যারাইটি জাতটি সহজলভ্য। এটি জাপানের Hydrangea macrophylla জাতের সংকর। হাইড্রেনজিয়ার প্রায় আশিটি জাতের অধিকাংশই শীতপ্রধান দেশে সহজলভ্য। এ ফুল ফোটার সময় বসন্ত ও গ্রীষ্ম। আমাদের দেশে বসন্তের শেষভাগ থেকেই ফুটতে শুরু করে ফুলটি। নজরকাড়া সৌন্দর্য্যের কারণে কদর বাড়ছে চিত্তাকর্ষক হাইড্রেনজিয়ার।
স্থান নির্বাচন:-
হাইড্রেনজা উজ্বল সূর্যের আলোর চেয়ে হালকা ছায়ায় স্থানে ভালভাবে বৃদ্ধি পায়। বাগানে বা আউটবিল্ডিং বরাবর পূর্ব বা পশ্চিম দিকে মুখ করে গাছ রাখতে হবে। যাতে সকালের এবং বিকেলের হালকা জ্বলন্ত সূর্যের রশ্মি আসে ফলে গাছের কোন ক্ষতি হয় না।
টব নির্বাচন:-
হাইড্রেনজিয়া গাছটি একটু ঝোপালো প্রকৃতির হয় তাই সবসময় এই গাছের জন্য দশ বা বারো ইঞ্চি টব নেওয়া আবশ্যক।
মাটির ব্যবস্থাপনা :-
এই গাছের জন্য হালকা ধরণের মাটি প্রস্তুত করতে হবে, যে মাটিতে পানি একেবারেই দাঁড়ায় না। তাই এর জন্য দরকার একভাগ গার্ডেন সয়েল( উর্বর বেলে দোঁয়াশ মাটি), একভাগ নদীর সাদা বালি(river sand or silver sand), একভাগ ভার্মিকম্পোস্ট বা একবছরের পুরোনো পচানো গোবর সার বা পাতাপচা সার এবং একভাগহাঁড়গুড়ো চার কোল। এর সাথে দশ থেকে বারো ইঞ্চি টবের জন্য এক চামচ হাঁড়গুড়ো, এক চামচ শিংকুঁচি, এক চামচ নিমখোল এবং দেড়চামচ ফসফেট মিশিয়ে নিতে হবে।
আলোর ব্যবস্থাপনা :-
এই গাছ সরাসরি রোদ পায় এমন জায়গায় ও রাখা যেতে পারে আবার হালকা ছায়াযুক্ত জায়গায় ও রাখা যেতে পারে। তবে গ্রীষ্মকালে যেহেতু রোদের তীব্রতা খুব বেশি তাই সরাসরি রোদে না রেখে একটু ছায়াযুক্ত জায়গায় রাখাই ভালো।
পানির ব্যবস্থাপনা :-
এই গাছে মোটামুটি নিয়মিত পানি দিতে হবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনভাবেই গাছের গোড়ায় পানি না জমে। গাছের গোড়ায় পানি জমলে এক সপ্তাহের মধ্যেই গাছটি মারা যেতে পারে। তাই পানি দেওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বণ করা প্রয়োজন।
খাবারের ব্যবস্থাপনা :-
চারাগাছ প্রতিস্থাপনের একেবারে শুরুতে জৈব সার দিতে হবে, প্রধানত নাইট্রোজেন সার এবং সামান্য পটাসিয়াম এবং ফসফরাস সমৃদ্ধ। পরবর্তী সময়ে প্রতি দুমাস অন্তর এক চামচ সরিষার গুঁড়ো খোল, এক চামচ হাঁড়গুড়ো, এক চামচ শিংকুঁচি, এক চামচ নিমখোল ও হাফ চামচ পটাশ একসাথে মিশিয়ে টবের মাটিতে দিতে হবে।
প্রতিস্থাপনের সময়কাল:-
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে চারাগাছ রোপণ করা যেতে পারে। তা হলে গ্রীষ্মে গাছটি দ্রুত বৃদ্ধি পারে এবং ঝোপের ন্যায় আকার নেবে, ফলে শীতের মাঝামাঝি সময় থেকে গাছে ফুল আসতে শুরু করবে। এছাড়াও বর্ষার পরে চারা গাছ রোপণ করা যেতে পারে ।
বর্ষা এবং শরৎকালে বিশেষ পরিচর্যা:-
এই মরসুমের হাইড্রেঞ্জা গাছের বিশেষ যত্ন এবং পরিচর্যার প্রয়োজন, গাছে কম পানি দিতে হবে, প্রয়োজনে মাটিতে হাত দিতে পরীক্ষা করে পানি দেওয়া প্রয়োজন, কারণ বর্ষাতে এবং শরৎ-এ বৃষ্টির পরিমান বেশি হয়, তাই বেশি আদ্রতা গাছের পক্ষে বিপদজনক। এই সময়ে গাছ ছত্রাক রোগে আক্রান্ত হয়, তাই প্রতিরোধ হিসাবে প্রতি ৭ থেকে ১০ দিন অন্তর ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
গরমকালের বিশেষ পরিচর্যা:-
বর্ষার মতো গরমের মরসুমে হাইড্রেঞ্জা গাছের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন, আবহাওয়া বুঝে গাছে পানি দিতে হবে, উপরের মাটি দেড়, দুই ইঞ্চি শুঁকিয়ে গেলে তবেই পানি প্রয়োগ করতে হবে, প্রয়োজনে মাটিতে হাত দিতে পরীক্ষা করে পানি দেওয়া প্রয়োজন। তীব্র গরমে এবং রৌদে গাছ ছায়ায় স্থানে রাখতে হবে তা না হলে গাছ মাড়া যাবে। গ্রীষ্মের সময়ে তাপমাত্রা ৩৫ র উপরে হলে, প্রতিদিন দু বেলা হাইড্রেঞ্জায় গাছে সাওয়ার দিতে হবে।
রোগপোকা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি:-
হাইড্রেনজিয়া গাছে প্রধানত দুটি রোগ দেখতে পাওয়া যায়। পাউডারি মিল ডিউ ও পাতার ব্ল্যাক স্পট। এর জন্য M45 এক লিটার পানিতে এক গ্রাম দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে সাতদিন পর পর নিয়মমাফিক স্প্রে করা যায় তবে এই রোগের আক্রমণ হবে না।
অ্যাফিডস এর জন্য ইমিডাক্লোরোপিড কম্পোজিসনের যে কোন কীটনাশক এক লিটার পানিতে পাঁচ ফোঁটা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে পাঁচদিন অন্তর অন্তর স্প্রে করতে হবে।
মাইটস এর জন্য ফেনাজোকুইন বা ডাইগোফল কম্পোজিসনের যে কোন কীটনাশক এক লিটার পানিতে দেড় মিলি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে ৭ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করতে হবে।
তবে ডাইমেথয়েড 30% কম্পোজিসনের রোগর, রোগরপ্লাস, টাফগর এক লিটার পানিতে তিরিশ ফোঁটা দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে গাছ বসানোর দশ দিন পর থেকে নিয়মিত পনের থেকে কুড়িদিন অন্তর যদি স্প্রে করা যায় তবে কোন পোকার আক্রমণ হবে না।হাইড্রেনজা সরাসরি সূর্যের আলো পছন্দ করে না, পরোক্ষ সূর্যালোক পছন্দ করে, সকালের হালকা আলো পায় তেমন স্থানে রাখবেন সরাসরি সূর্যালোক সহ আপনার গাছটিকে জানালা থেকে তিন ফুট দূরে রাখুন।